ভিয়েতনামের করোনা জয়ের গল্প

চীনের সঙ্গে বিশাল সীমান্ত থাকা সত্ত্বেও ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দেশ ভিয়েতনাম নিজ ভূখণ্ডে ৩০০’র সামান্য বেশি কোভিড-১৯ রোগী এবং প্রাণহানি শূন্য রেখে রেকর্ড গড়ে এই মহামারি জয়ে রূপকথার এক গল্প তৈরি করেছে।

কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সর্বশেষ ঘটনা শনাক্ত হওয়ার প্রায় এক মাস পার করে দেশটি ইতোমধ্যে সবকিছুই খুলতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অন্যান্য দেশ যখন করোনা সংক্রমণ এবং বিশাল মৃত্যু দেখেছে; তখন ভিয়েতনাম দেখেছে সামান্য সংক্রমণ। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ায় পুরোপুরি সফল হয়েছে।

তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে ভিয়েতনামের ব্যয়বহুল এবং শ্রম ঘনিষ্ঠ পদ্ধতির ত্রুটি থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিয়েতনামের সফলতা থেকে শিক্ষা নিতে বেশিরভাগ দেশই দেরী করে ফেলছে।

কঠোর, তবে বুদ্ধিদ্বীপ্ত ব্যবস্থা

ভিয়েতনামের হ্যানয়ের হার্ভার্ড পার্টনারশিপ ফল হেলথ অ্যাডভান্সমেন্টের অধ্যাপক ডা. টোড পোলাক বলেন, আপনি যখন এ ধরনের বিপজ্জনক অজানা নতুন রোগজীবাণু মোকাবিলা করবেন তখন তা অত্যধিক প্রতিক্রিয়াশীল উপায়ে মোকাবিলা করাই উত্তম।

ভাইরাসটির মৃদু বিস্তার ঘটলেও মেডিক্যাল ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়বে; সেটি স্বীকার করেই ভিয়েতনাম এই ভাইরাসকে শুরুতেই ব্যাপক মাত্রায় প্রতিরোধের পন্থা বেছে নেয়।

করোনার একজন রোগী না পাওয়া গেলেও জানুয়ারির শুরুর দিকে ভিয়েতনামের সরকার রহস্যজনক নতুন নিউমোনিয়া মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল; যদিও ওই সময় উহানে অজানা এই রোগে মাত্র দু’জন মারা যান।

২৩ জানুয়ারি দেশটিতে প্রথম ভাইরাস শনাক্ত হয় এক ব্যক্তির শরীরে; এই ব্যক্তি সেই সময় উহান থেকে হো চি মিন শহরে ফিরে আসেন। ওইদিনই ভিয়েতনামের জরুরি পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়।

হো চি মিন শহরের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চের (ওইউসিআরইউ) পরিচালক অধ্যাপক গাই থওয়েটিস ভিয়েতনাম সরকারের সংক্রামক ব্যাধি কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, এটি খুব, খুব দ্রুত কার্যকর করা হয়; যা বেশ কঠোর মনে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় এই কাজটি ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিদ্বীপ্ত।

ভিয়েতনাম যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেসব ব্যবস্থা নিতে কয়েক মাস লেগে যায়। ভিয়েতনাম শুরুতেই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং চীনের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। কঠোর পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সীমান্ত ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা বৃদ্ধি করে।

চন্দ্রবর্ষের ছুটিতে স্কুল বন্ধ করে দেয় জানুয়ারির শেষের দিকে; মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্যাপক পরিসরে, কষ্টসাধ্য এবং শ্রমঘনিষ্ঠ উপায়ে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যকর শুরু করে।

অধ্যাপক গাই থওয়েটিস বলেন, এটি এমন একটি দেশ যারা অতীতে অনেক প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করেছে। ২০০৩ সালের সার্চ থেকে শুরু করে ২০১০ সালের অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ডেঙ্গু ও হামের প্রাদুর্ভাবও মোকাবিলা করেছে।

তিনি বলেন, দেশটির সরকার এবং সাধারণ জনগণও সংক্রামক ব্যাধিগুলো মোকাবিলায় খুবই অভ্যস্ত এবং এসবের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। এ দিক থেকে বিশ্বের অনেক সম্পদশালী দেশের চেয়ে এগিয়ে তারা। তারা জানেন কীভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ের দিকে ভিয়েতনাম দেশটিতে আগত প্রত্যেককে এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন; তাদের সবাইকে ১‌৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এর ব্যয়ভার পুরোটাই বহন করেছে সরকার; যদিও থাকার জায়গাগুলো বিলাসবহুল ছিল না।

একজন নারী যিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে ভিয়েতনামে উড়ে আসেন। বিবিসিকে এই নারী বলেন, অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ভিয়েতনামকে তিনি নিরাপদ মনে করেন। দেশে ফেরার প্রথম দিন তাকে শুধু একটি মাদুড় দেয়া হয়েছিল। বালিশ, কম্বল দেয়া হয়নি। তবে যে রুমে ছিলেন, সেখানে একটি ফ্যান ছিল।

উপসর্গবিহীনদের নিয়ন্ত্রণ

অধ্যাপক গাই থওয়েটিস বলেন, সংক্রমিতদের অধিকাংশই লক্ষণ বা উপসর্গহীন থাকার প্রমাণ পাওয়ার পর বৃহৎ পরিসরে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়। অসুস্থ হোক বা না হোক কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রত্যেকের পরীক্ষা করা হয়।

তিনি বলেন, ভিয়েতনামে সংক্রমিতদের প্রায় ৪০ শতাংশই জানতেন না যে তারা ভাইরাসটি বহন করছেন। তারা পরীক্ষার কথা চিন্তাও করতেন না।

গাই বলেন, আপনার যদি এ ধরনের উপসর্গবিহীন বাহক থাকে তাহলে এটিকে নিয়ন্ত্রণের একটি মাত্র উপায় আছে। আর সেটি হলো ভিয়েতনাম যা করেছে সেটি অনুসরণ করা। আপনি যদি এই লোকদের আটকাতে না পারেন, তাহলে তারা ঘুরে ঘুরে সংক্রমণের বিস্তার ঘটাবে।

দেশটিতে কোনও মৃত্যুর ঘটনা না ঘটার ব্যাখ্যা দিতেও এটি সহায়তা করবে।

ভিয়েতনামে যারা ফিরে এসেছিলেন, তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, পর্যটক অথবা ব্যবসায়ী পর্যটক। তারা ছিলেন কমবয়সী এবং স্বাস্থ্যবান। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাদের নিজেদেরই ভালো সুযোগ ছিল। বয়স্কদের ক্ষেত্রে যে ধরনের ঝুঁকি থাকে তাদের সেটি ছিল না। যে কারণে দেশের মেডিক্যাল সংশ্লিষ্টরা স্বল্প সংখ্যক আশঙ্কাজনক রোগীর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পেরেছেন।

ভিয়েতনাম সারাদেশে পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর করেনি। তবে যখন কোনও ক্লাস্টার পাওয়া গেছে সেই এলাকায় ব্যবস্থা নিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হ্যানয়ের উত্তরের সন লোই শহরে বেশ কয়েকজন শনাক্ত হন। পরে এক হাজারের বেশি মানুষের ওই এলাকা বন্ধ করে দেয়া হয়। একই ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর কাছে হা লোই শহরে; যেখানে ১১ হাজার মানুষের বসবাস। একটি হাসপাতালও সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়।

এসব এলাকায় দুই সপ্তাহের মধ্যে কেউ প্রবেশ কিংবা বের হতে পারবেন না। স্থানীয় এই ব্যবস্থা আবারও কার্যকর করা হবে যদি সেখানে ভাইরাসটি ফিরে আসে। এর অর্থ হলো- ভিয়েতনাম সারা দেশে ব্যাপক সংখ্যক পরীক্ষা করেনি।

অধ্যাপক গাই থওয়েটিস বলেন, প্রাথমিকভাবে এই কৌশলকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি পুরোপুরি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। তারা পুরোপুরি আইসোলেট করতে সক্ষম হয়েছিল এবং শনাক্ত রোগীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিল।

জনগণের উদ্দেশে পরিষ্কার একটি বার্তা

এমনকি ভিয়েতনামের মতো এক দলীয় শাসনব্যবস্থার রাষ্ট্রেও আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে, যে কৌশলটি নিতে যাচ্ছেন সেটি জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অধ্যাপক ডা. টোড পোলাক বলেন, সরকার জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আসলেই একটি ভালো কাজ করেছে। আর এটির প্রয়োজন ছিল।

একেবারে শুরুর দিকে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ফোনে নিয়মিত ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হতো। এতে নিজেকে রক্ষার জন্য কি করতে হবে সেব্যাপারে দিকনির্দেশনা থাকতো। এক সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ভিয়েতনাম ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর জন্য প্রোপাগান্ডা মেশিনের ব্যবহার করেছিল।

ডা. টোড পোলাক বলেন, শত্রুকে পরাজিত করার জন্য সমাজের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার বোধ তৈরি করেছিল এই প্রচার। তিনি বলেন, সরকারের এই কাজে দেশের বৃহৎসংখ্যক মানুষ অংশ নিয়েছিল। কারণ তারা দেখেছেন, সরকার দেশের জনসাধারণকে রক্ষার জন্য, সফলতার জন্য সাধ্যের সবটুকু করার চেষ্টা করছে।

ভিয়েতনামের পরিসংখ্যান কি বিশ্বাস করা যায়?

ভিয়েতনাম সরকারের পরিসংখ্যান আশ্চর্যজনকভাবে কম। যা নিয়ে অনিবার্য প্রশ্ন উঠছে আসলেই কি এই পরিসংখ্যান সঠিক। কিন্তু দেশটির মেডিক্যাল এবং কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

ডা. টোড পোলাকের দল দেশটির প্রধান সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত। তিনি বলেন, যদি অনিবন্ধিত, চিকিৎসাসেবার বাইরের অথবা মিসিং কোনও রোগী থাকতো তাহলে আমরা সেগুলো হাসপাতালের ওয়ার্ডে দেখতাম। কিন্তু আমরা এমন কিছুই পাইনি।

তার দল অন্তত ২০ হাজার পরীক্ষা করেছে। তিনি বলেন, তাদের পরীক্ষার ফল সরকারের প্রকাশিত পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিল রয়েছে। সেখানে কোনও ঘটনা লুকানো হয়নি। এটার ব্যাপারে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী।

অধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ

ভিয়েতনামের একেবারে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব কমিউনিটি ধাঁচের। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রধান ফিল রবার্টসন বলেন, সামাজিক দূরত্ব এবং কোয়ারেন্টাইন কার্যকর করা স্থানীয় দলীয় ক্যাডারদের ওপর নির্ভরশীল। এই ক্যাডাররা তাদের এলাকায় এগুলো নিশ্চিত করতে কাজ করেন এবং ঊর্ধ্বতনদের অবগত করেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, সন্দেহাতীতভাবে এই বাড়াবাড়ির প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। গণমাধ্যমের ওপর সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকায় অনেক মানুষের কাছে এসব খবর পৌঁছায় না। ভাইরাসটি মোকাবিলায় সরকারের ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করায় অনেক মানুষকে জরিমানা এবং নিপীড়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ফিল রবার্টসন।

একক এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ মিশনে দেশটির অর্থনীতি, সমাজ এবং অন্যান্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা এখনও পরিষ্কার নয়।

অধ্যাপক গাই থওয়েটিস বলেন, ভিয়েতনামে যে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, ব্যাপক সংক্রমণের শিকার দেশগুলো সেই ব্যবস্থা এখন গ্রহণ করতে পারবে না। তবে স্বল্প সংক্রমিত কিছু দেশ এখনও ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই সবসময় উত্তম এবং প্রতিরোধ সর্বদা স্বস্তা।

তিনি বলেন, ভিয়েতনামে যদি ব্যাপকসংখ্যক রোগী পাওয়া যেতো তাহলে সন্দেহাতীতভাবেই তাদের বর্তমান ব্যবস্থা প্রচুর লড়াইয়ের মুখোমুখি হতো। তবে তারা যা করেছে, তার স্বাস্থ্য-অর্থনীতির উপকারের কোনও তুলনা হয় না।

দৈনিক আমার বাংলাদেশ

দৈনিক আমার বাংলাদেশ