সুন্দরবনের বাঘ বৃদ্ধির টেকসই পথ

বাংলাদেশ ও ভারতের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, যার ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশের ২০১৮ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ আছে ১১৪টি। এ সংখ্যা ২০১৫ সালের বাঘশুমারি থেকে ৮টি বেশি। ভারতের ২০১৯ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ আছে ৯৬টি। এ সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল ৮৭। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় সুন্দরবন অংশে বাঘ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেখানকার বন বিভাগ অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে ভারতে বাঘের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভারতীয় সুন্দরবনের ভেতর যেসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করত, তাদের সরিয়ে অন্যত্র পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাঘের বিচরণস্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও জনসাধারণের চলাচল পর্যবেক্ষণ ও সীমিতকরণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের আয়তনও বেড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে কিছুদিন আগেও সুন্দরবনের গহিনে বনদস্যু ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোলাগুলি ও অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল; যদিও তা বর্তমানে অনেকাংশে কমে এসেছে।তারপরও বাংলাদেশের সুন্দরবনে মানুষের চলাচল ভারতীয় অংশ থেকে অনেক বেশি। মধু সংগ্রহ, গোলপাতা সংগ্রহ, মাছ ধরা, বনের কাঠ ও লাকড়ি সংগ্রহ করার জন্য মানুষ অবাধে বনে ঢুকছে। যার ফলে বাঘ যেমন অনিরাপদ বোধ করছে, এর সঙ্গে সঙ্গে বাঘ ও মানুষের সংঘর্ষও বাড়ছে। সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং অভ্যন্তরীণ সব মানুষকে সরিয়ে পুনর্বাসন করা উচিত। মাছ চাষ প্রকল্প, গবাদিপশু পালন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং কৃত্রিম উপায়ে মধু সংগ্রহ প্রকল্প স্থাপন করে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা অনেক কমানো যায়। সুন্দরবন ও লোকালয়ের মধ্যে সোলার প্যানেল স্থাপন করলে লোকালয়ে বাঘের প্রবেশ কমানো সম্ভব।

সুন্দরবনে অল্পসংখ্যক বাঘ থাকায় তাদের মধ্যে ইনবিড্রিং তথা নিকট সম্পর্কের মধ্যে প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে বাঘশাবকের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। তাই বাঘ সংরক্ষণে মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে।

সুন্দরবনের বাঘ ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং হরিণের ওপর নির্ভরশীল। অবৈধভাবে কাঠ সংগ্রহ করার ফলে ঝোপঝাড় কমে যাচ্ছে। ঝোপঝাড় কমে গেলে হরিণ শিকার করা বাঘের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ইদানীং নতুন করে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে অস্বাভাবিকভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করায় মিঠাপানির অভাব এবং পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রাকৃতিক জলাধারের সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

পুনঃপ্রবর্তন (রি-ইন্ট্রোডাকশন) পদ্ধতিতে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি

জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বছর বছর ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দেখা দিচ্ছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাস। জলবায়ু পরিবর্তনে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি মিলে মানুষসহ পশুপাখি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ রক্ষায় সুন্দরবনের টেকসই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর সুন্দরবন টেকসই করার জন্য বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই।

১১৪টি বাঘের মধ্যে যদি ২০টি প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বাঘও থাকে, তাদের থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০টি বাঘ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেভাবে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে বাঘের জিনগত বৈচিত্র্যের অভাব। অল্পসংখ্যক বাঘ থাকায় তাদের মধ্যে ইনবিড্রিং তথা নিকট সম্পর্কের মধ্যে প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে বাঘশাবকের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। তাই বাঘ সংরক্ষণে মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য বাঘের জিনগত বৈচিত্র্যও আনা প্রয়োজন। হেটারোজেনোসিটি বৃদ্ধি করতে পারলে বাঘের বংশ যেমন বৃদ্ধি পাবে, সেই সঙ্গে বাঘের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি ও যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে বাঘকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। জিনগত বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে পুনঃপ্রবর্তন। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে সুন্দরবনে অনেকসংখ্যক বাঘ ছাড়া সম্ভব। এ জন্য নিম্নোক্ত ধাপগুলোর মাধ্যমে বাঘ পুনঃপ্রবর্তন করে সুন্দরবনে নতুন করে বাঘ ছাড়া যায়।

ক. বাঘ সংগ্রহ: বাংলাদেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক থেকে ১০টি বাঘ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এদের থেকে ক্যাপটিভ বিড্রিং করিয়ে জন্ম নেওয়া শাবকগুলো ছয় মাস বয়স হলে সুন্দরবনের কাছে বড় পরিসরে লালনপালনের ব্যবস্থা করা। পরবর্তী সময়ে এদের ধাপে ধাপে ট্রেনিং করিয়ে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে হরিণ পর্যন্ত শিকার করার অভ্যাস শেখানো সম্ভব। পরে এসব বাঘশাবক প্রাপ্তবয়স্ক হলে এদের থেকে নতুন জন্ম নেওয়া বাঘশাবক একই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক হলে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ছাড়া হবে।

খ. ক্যামেরা ট্র্যাকিং: সুন্দরবনে ছাড়ার আগে ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনের যেসব অংশে বাঘ নেই, সেসব অংশ চিহ্নিত করা। যাতে অন্য বাঘের সঙ্গে সংঘর্ষ না হয়। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে অবমুক্ত বাঘগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা।

গ. খাদ্য প্রস্তুত: ওই প্রকল্পের পাশে একই সঙ্গে হরিণ ও শূকরের খামার তৈরি করে এদের বংশবিস্তার করানো। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী হরিণ ও শূকরের একটি নির্দিষ্ট অংশ নতুন বাঘের এলাকায় খাদ্য হিসেবে প্রেরণ করা। এর মাধ্যমে বাঘের খাবারের সংকট দেখা দেবে না এবং বাঘ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় ঢুকবে না।

বাংলাদেশে দ্রুততার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে যে হারে জলবায়ু পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তাতে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে। এত অল্পসংখ্যক বাঘের প্রবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে টিকে থাকা ভবিষ্যতে খুবই কষ্টসাধ্য হবে। তাই অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার বিষয়ে কাজ শুরু করা উচিত।

ডা. মো. শাহাদাত হোসেন ডেপুটি কিউরেটর, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, চট্টগ্রাম

Source: Prothomalo