টিকা এসে গেছে, দয়া করে শিক্ষাটা খুলে দিন

গত সপ্তাহের (২৪ জুলাই ২০২১) কলামে টিকা পাওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলাম। এর প্রতিক্রিয়ায় একজন মন্ত্রী লিখেছেন, টিকা আনার ক্ষেত্রে দেশের রাজনীতিকদের যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল, সে কথা আমার লেখায় আসেনি। অর্থাৎ রাজনীতিকদের কৃতিত্ব অস্বীকার করেছি। কথাটি ঠিক নয়। বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আনার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যে নিরলস চেষ্টা করে আসছেন, এখনো করছেন, সে কথা একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি।

ওই লেখায় যে রাজনীতিকদের কথা বলেছি, তাঁদের কেউ কেউ সরকারে থাকলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নন। আমরা বলেছি, ‘আমাদের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা যখন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাফল্যের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে প্রায় প্রতিদিন বাহাস করে চলেছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী চার বাংলাদেশি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কোভ্যাক্স থেকে বিনা মূল্যে টিকা পেতে।’

মন্ত্রী মহোদয় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় আরও জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের যে চার চিকিৎসক বাংলাদেশে বিনা মূল্যে টিকা পেতে বাইডেন প্রশাসনে তদবির করেছেন, তাঁরা সেখানকার আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা। আমরা তো দেশের ভেতরেও এ রকম নেতা চাই, যাঁরা নিজেদের দায়িত্বের বাইরে গিয়েও এই দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরকালে টিকা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়ার পরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টিকা পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবখানে চেষ্টা করেছে। তাদের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভুলের জন্য রাশিয়া চুক্তি করতে বিলম্ব করে কিংবা চীন উষ্মা প্রকাশ করে, তখন তার সমালোচনা না করে পারি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের চার প্রবাসী চিকিৎসকের উদ্যোগের পেছনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তাগিদ ছিল।

টিকা আমদানির ক্ষেত্রে প্রথমে যে সরকারের সমালোচনা হয়েছে, তার দুটো কারণ ছিল। প্রথমত তৃতীয় পক্ষ বা মধ্যস্থতাকারীকে অন্তর্ভুক্ত করা। দ্বিতীয়ত অন্য উৎসের সন্ধান না করা। পরবর্তীকালে সরকার অন্যান্য দেশ থেকে টিকা কেনার ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। কোনো মধ্যস্থতাকারী রাখেনি। এর অর্থ আমাদের সমালোচনা যৌক্তিক ছিল।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এত দিন টিকার দোহাই দিয়েছিল। এখন টিকা এসে গেছে কিংবা আসার পথে আছে। অতএব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো না খোলার কোনো যুক্তি নেই। শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকি বেশি। আমরা আশা করব, সরকার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যবস্থা করবে।

বিলম্ব হলেও সরকার প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহ করতে পারছে, তা অবশ্যই আশার কথা। শুক্রবার প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, দ্রুত বেশি মানুষকে টিকা দিতে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতি মাসে এক কোটি ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন দিনে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তখন অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ পাচ্ছি, এক মাস আগে টিকার জন্য নিবন্ধন করেও তাঁরা তারিখ পাচ্ছেন না। কী কারণে নিবন্ধন করে মানুষকে এক মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে, সেই ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি করছি।

আমরা আগে থেকে বলে আসছি, টিকা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। মাসে এক কোটি টিকা দিলেও দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে দুই বছরের বেশি লেগে যাবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাব দিয়েছেন, এক-দেড় বছরের মধ্যে ২২ কোটি টিকা পাওয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশেই করোনার টিকা উৎপাদন করা হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা আশা করতে পারি, টিকার অভাব হবে না। সরকার ইতিমধ্যে ২৫ বছরের ওপরের সবাইকে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও আছেন অগ্রাধিকারের তালিকায়।

বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইবতেদায়ি ও কওমি মাদ্রাসাগুলোর চলমান ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আগের ঘোষণা অনুযায়ী এই ছুটি ছিল ৩১ জুলাই পর্যন্ত। তাদের ভাষায়, ‘সারা দেশে করোনা পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ায় এবং কঠোর “লকডাউন”কার্যকর থাকায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিবেচনায় কোভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে ছুটি বাড়ানো হয়েছে।’

বেশ কয়েকজন জনস্বাস্থ্যবিদের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। জিজ্ঞেস করি, দ্বিতীয় ঢেউ এখন কোন পর্যায়ে আছে। তাঁরা বললেন, আগস্টের ১০–১২ তারিখ পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়তির দিকে থাকবে ধারণা করি। এরপর নিচে নেমে আসবে। ভারতেও তা-ই হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশেও একই অবস্থা লক্ষ করেছি।

৫ আগস্ট পর্যন্ত বিধিনিষেধ আছে। আশা করা যায়, এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে বিধিনিষেধ পুরোপুরি উঠে না গেলেও শিথিল হবে। কিন্তু দেশের হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কী হবে? তারা কবে ক্লাসে-পরীক্ষায় ফিরে যেতে পারবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত আকারে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রত্যেক বিভাগের জন্য তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হবে না। জেএসসি ও পিইসির বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত বছর করোনার কারণে এই দুটি বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। এবারও হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। যেখানে অতি আবশ্যকীয় পরীক্ষা সরকার নিতে পারছে না, সেখানে ‘অপ্রয়োজনীয়’ পরীক্ষা নিয়ে টানাটানি কেন? শিক্ষাবিদেরা এই দুটি পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বাতিল করতে বলেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে সরকার আমলে নেয়নি।

গত বছর ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এক ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ফের ছুটির ঘোষণা আসে। আশা করি, ৩১ আগস্টের পর আর ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হবে না। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বেশ কিছুদিন আগে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। গত মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে একটি রূপরেখাও দেওয়া হয়েছিল। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

জেএসসি ও পিইসির বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত বছর করোনার কারণে এই দুটি বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। এবারও হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। যেখানে অতি আবশ্যকীয় পরীক্ষা সরকার নিতে পারছে না, সেখানে ‘অপ্রয়োজনীয়’ পরীক্ষা নিয়ে টানাটানি কেন? শিক্ষাবিদেরা এই দুটি পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বাতিল করতে বলেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে সরকার আমলে নেয়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না খোলার বিষয়ে যখন সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে, তখন ইউনেসকো মুখপাত্র জেমস এল্ডার কী বলেছেন। জেনেভায় গত মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, এভাবে (স্কুল বন্ধ) চলতে পারে না। বিভিন্ন দেশের সরকার কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলা এবং এ রোগের বিস্তার যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া পর্যন্ত স্কুল খোলার জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়। ১২ জুলাই ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ও ইউনেসকোর মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুল যৌথ বিবৃতিতে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে। লাখ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। অতএব, অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক। ১২ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বের যে ১৯টি দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এত দিন টিকার দোহাই দিয়েছিল। এখন টিকা এসে গেছে কিংবা আসার পথে আছে। অতএব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো না খোলার কোনো যুক্তি নেই। শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকি বেশি। আমরা আশা করব, সরকার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যবস্থা করবে (পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকারে ইউজিসি চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ বলেছেন, এক-দুই মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে)। এরপর স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলো। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হোক। সব শেষে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

আমাদের শেষ কথা, টিকা এসে গেছে, দয়া করে শিক্ষাটা খুলে দিন।

Source: Prothomalo