ব্যায়াম করলে ক্যালরি খরচ হয় না!

বেশ কয়েক বছর আগে কথা। অফিসের কয়েক কলিগ মিলে ঘুরতে গেছি। রাতে বারবিকিউ পার্টি ছিল। আস্ত খাসি দিয়ে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, একজন টিলা বেয়ে উঠছেন, নামছেন। ঘটনা কী, জানতে চাইলে বললেন, ‘ভাই, রাতে যা খাইছি, তা বার্ন করতে হবে না!’

হ্যাঁ, সত্যিই তো। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, দৌড়ালে, ব্যায়াম করলে শরীরের ক্যালরি ক্ষয় হয়। আর এখনকার গবেষকেরা কিনা বলছেন, আমাদের এত দিনকার জানাশোনায় একটু গলদ আছে। দৌড়াদৌড়ি কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে যতটা ক্যালরি ক্ষয় হয়, শুয়ে-বসে থাকলেও একই পরিমাণ ক্যালরি ক্ষয় হয়!বিষয়টি যাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে, তাঁর নাম হারমান পন্টজার। তিনি পেশায় নৃবিজ্ঞানী। সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের তিনি তাঁর গবেষণা ফলাফল নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন ২০১৭ সালে। তাতে তিনি শিকারি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত তানজানিয়ার হাডজাদের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা অফিসে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে কাজ করে যে পরিমাণ ক্যালরি ক্ষয় করি, পশু শিকারের মতো কঠিন কাজ করেও তারা একই পরিমাণ ক্যালরি ক্ষয় করে। পন্টজার লিখেছেন, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে যেটা জেনে এসেছি, আমাদের প্রাপ্ত উপাত্ত তার উল্টোটা বলে। শারীরিকভাবে যত বেশি কিংবা কম সক্রিয় থাকুক না কেন, সব মানুষের একই ক্যালরি ক্ষয় হয়। এর উত্তর খুঁজতে পন্টজার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভ রাইচলেনকে সঙ্গে নিয়ে হাডজাদের কাছে গেছেন। পৃথিবীতে যে কয়টি শিকারি সম্প্রদায় এখনো টিকে আছে, হাডজারা তাদের অন্যতম। তাঁরা দুজন মিলে খুঁজে বের করতে চেয়েছেন, গাড়ি-ঘোড়া ও কম্পিউটার প্রযুক্তি আসার আগে আমাদের শরীর কীভাবে কাজ করেছে, তার বিস্তারিত।

গবেষণায় দেখা গেছে, হাডজা পুরুষেরা শিকারের কাজে বিপুল ক্যালরি খরচ করেন। এ ক্যালরি খরচ নিয়ে তাঁরা মোটেও চিন্তিত নন। কারণ, শিকার থেকে পাওয়া খাবার দিয়ে তাঁরা সেটা পুষিয়ে নেন। কিন্তু প্রতিদিন তো শিকার মেলে না। তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন নারীরা। হাডজা নারীরা সকাল হলেই ফলমূলের সন্ধানে বের হন। নারীরা যদি ফলমূলের সন্ধানে বের না হতেন, তাহলে তাঁদের না খেয়ে থাকতে হতো। এই যে তন্ন তন্ন করে খাবার খুঁজে বের করা, এটাই মানুষকে সফলতার দিকে নিয়ে গেছে। মানুষকে অনন্য করে তুলেছে।

জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষকদের দীর্ঘদিনের ধারণা, শিকারি সম্প্রদায়ের মানুষেরা আজকের শহুরে মানুষের চেয়ে বেশি ক্যালরি খরচ করে। হাডজারা কী পরিমাণ কঠিন কাজ করে, তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করা কঠিন। আজ আমরা সেই পরিমাণ পরিশ্রম করি না বলেই ক্যালরি জমে জমে আমাদের মধ্যে স্থূলতা রোগের হার এত বেড়ে গেছে। পন্টজার জানিয়েছেন, এই গবেষণার পেছনে একটা জিনিস দেখার ইচ্ছা ছিল, তা হলো শক্তি (এনার্জি) কমে যাওয়ার পর হাডজাদের বিপাক অঙ্গের আকার কেমন দাঁড়ায়। পাশাপাশি প্রতিদিনের ক্যালরি খরচ করলে পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে কী ঘটে, সেটা দেখা।

তানজানিয়া থেকে হাডজাদের বিভিন্ন জিনিসের নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে আশ্চর্য হয়ে যান তাঁরা। হাডজা পুরুষেরা প্রতিদিন ২ হাজার ১০০ ক্যালরি আর নারীরা ১ হাজার ৯০০ ক্যালরি খরচ করেন। ইউরোপ, আমেরিকার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও প্রতিদিন একই ক্যালরি খরচ করেন। ব্যাপারটা তাঁদের ভাবিয়ে তোলে। তাঁরা আরও ব্যাপক পরীক্ষায় যান। এবার শরীরের আকার, চর্বির পরিমাণ, বয়স, লিঙ্গ সবকিছু বিবেচনায় নেন। কিন্তু ফলাফল একই! কীভাবে সম্ভব এটা? তাঁরা কি কোনো কিছু বাদ দিয়েছেন? মানুষের বায়োলজির মধ্যে কি কোনো গলদ রয়ে গেছে?

বেশি পরিশ্রমে বেশি ক্যালরি খরচ হয়—এ ধারণা প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আশি ও নব্বইয়ের দশকে। এ সময় গুয়েতেমালা, গাম্বিয়া ও বলিভিয়ার কৃষকদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কৃষকেরা তাঁদের দৈনন্দিন কাজে যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ করেন, শহরের মানুষেরা আরাম-আয়েশে থেকেও একই ক্যালরি খরচ করে। ২০০৮ সালে আরেক গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত হয়। এটি পরিচালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষক অ্যামি লিউক। তিনি নাইজেরিয়ার গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে শিকাগোর আফ্রো-আমেরিকানদের শক্তি ক্ষয় ও শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যে তুলনা করে একই ফলাফল পান। এরপর লিউককে সঙ্গে নিয়ে লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়ের লারা ডুগাস সারা বিশ্ব থেকে ৯৮টি গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বসেন। এবারও ফলাফল একই।

শুধু মানুষই নয়, অন্যান্য প্রজাতিও নিদিষ্ট হারে শক্তি ব্যয় করে। হাডজাদের নিয়ে গবেষণার সময় পন্টজার অন্য প্রাইমেটদের নিয়েও কাজ করেন। তিনি দেখতে পান, জঙ্গলে মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো বন্য প্রাণী আর চিড়িয়াখানায় বন্দী প্রাণীদের ক্যালরি খরচের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা ভেড়া ও ক্যাঙারুর ওপর পরীক্ষায় একই ফল পান। ২০১৫ সালে চীনা গবেষকেরা পান্ডাকে চিড়িয়াখানা ও জঙ্গলে রেখে পরীক্ষা করে একই ফলাফল পান।

আরও বিস্তারিত জানতে অ্যামি লিউক ও তাঁর দল এবং লারা ডুগাসকে সঙ্গে নিয়ে হারমান পন্টজার আরও বড় পরিসরে মডেলিং দ্য এপিডেমিও-লজিক্যাল ট্রান্সজিশন স্টাডি (এমইটিএস) পরিচালনা করেন। তিন শতাধকি মানুষ এতে অংশ নেন। সবাইকে পুরো সপ্তাহের ২৪ ঘণ্টাই ফিটনেস ট্র্যাকার পরিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেখানে শারীরিক পরিশ্রমের সঙ্গে বিপাক ক্রিয়ার হালকা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। যাঁরা একেবারেই পরিশ্রম করেন না, তাঁদের থেকে যাঁরা একটু ব্যায়াম করেন, তাঁরা ২০০ ক্যালরি বেশি খরচ করেন।

এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের শরীর প্রতিদিন কী পরিমাণ শক্তি খরচ করবে, তা কীভাবে ঠিক করে নেয়? হাডজারা সারা দিন এত পরিশ্রম সত্ত্বেও কেন ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের সমান ক্যালরি ক্ষয় করে? পন্টজার এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানাননি। তবে তিনি একটি ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। তাঁর মতে, আমরা প্রতিদিন কত ক্যালরি খরচ করব, তার একটা বরাদ্দ থাকে। এই ক্যালরি যেসব কাজে ব্যয় হয়, আমরা তা জানি না। অতিরিক্ত শারীরিক কাজের পরও যাতে প্রতিদিনের বরাদ্দকৃত ক্যালরি খরচের পরিমাণ না বাড়ে, সে জন্য সে অন্যান্য জায়গার ক্যালরি খরচ থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে। একটা উদাহরণ দিই। ব্যায়াম করলে প্রদাহ কমে (ইনফ্লেমেশন)। ফলে ইমিউন সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করে। ল্যাবে যেসব প্রাণী আছে, সেগুলো ব্যায়াম করলে প্রতিদিনের শক্তি খরচে কোনো হেরফের হয় না। কিন্তু ব্যায়ামে যেটা হয়, তা হলো ওভুলেটরি সাইকেল কম হয় ও টিস্যু মেরামতের গতি ধীর হয়। এ জন্য মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতি প্রতিদিনের শক্তি খরচের পরিমাণ ঠিক রাখতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। আর এসব নির্দেশ করে, অলস হয়ে ঘরে পড়ে থাকার জন্য মানুষ মোটা হয় না। ওবেসিটি বা স্থূলতা রোগটি হয় অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার কারণে। অর্থাৎ মানুষ যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ করে, তার চেয়ে বেশি গ্রহণের কারণে মোটা হয়। মানুষের হাজার বছরের ইতিহাসে প্রতিদিনের শক্তি খরচের পরিমাণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাহলে আমরা আধুনিককালের স্থূলতা রোগের জন্য কাকে দায়ী করব? অবশ্যই অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করাকে।

যাক সে কথা। আমরা আলোচনা করছিলাম ব্যায়াম নিয়ে। এ সময়ের গবেষণা আমাদের বলছে, ওজন কমানোর জন্য ব্যায়াম খুব কমই কাজে লাগে। তার মানে কি আমরা ব্যায়াম করব না! না, তা নয়। ব্যায়ামের অনেক উপকারিতা রয়েছে। এটা হার্ট ও ইমিউন সিস্টেম ভালো রাখে। মস্তিষ্কের কাজে গতিশীলতা আনে। বয়সকালীন স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। প্রদাহও কমিয়ে রাখে। আমরা যেসব খাবার খাই, এর সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে। তাই খাদ্যতালিকার পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যায়াম যুক্ত হলে সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে, অযাচিত ওজন বৃদ্ধি হয় না। তবে মনে রাখতে হবে, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা আর ব্যায়াম দুটো আলাদা জিনিস, টুলস। দুটোর কাজও আলাদা। ব্যায়ামআপনাকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখবে। আর ওজন নির্ভর করবে আপনি কী খাচ্ছেন, তার ওপর। তাই যা খাবেন, একটু বুঝেশুনে খান।

Source: Proyhomalo

editor

Lorem Ipsum is simply dummy text of the printing and typesetting industry. Lorem Ipsum has been the industry's standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen book. It has survived not only five centuries