করোনায় আটকে আছে সাক্ষ্য গ্রহণ

  • ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ সব আসামিই এখন কক্সবাজার কারাগারে আছেন।
  • মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে ন্যায়বিচারের আশায় আছে সিনহার পরিবার।

    করোনারোধে চলমান বিধিনিষেধের কারণে আটকে আছে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে খুন হওয়া সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যার বিচার। চলতি মাসের ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত টানা তিন দিন এই মামলার প্রথম ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। আদালতে মামলার নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি বলে জানান সরকারি কৌঁসুলি। মামলাটি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।

    আজ ৩১ জুলাই পূর্ণ হচ্ছে সিনহা হত্যার এক বছর। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে ন্যায়বিচারের আশায় আছে সিনহার পরিবার।

    গত বছরের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া শামলাপুর এপিবিএনের তল্লাশিচৌকিতে গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। ঘটনার পাঁচ দিন পর ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে হত্যা মামলা করেন নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। তদন্ত শেষে র‍্যাব টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, তল্লাশিচৌকির পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে আসামি করে ১৩ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন প্রদীপসহ ৯ জন পুলিশ সদস্য। তিনজন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্য ও বাকি তিনজন বাহারছড়া গ্রামের বাসিন্দা। গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওসি প্রদীপসহ সব আসামিই এখন কক্সবাজার কারাগারে আছেন।

    ‘সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে অপরাধীদের কী শাস্তি হয়, তা দেখার জন্য। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন হয়।’

    শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস, মামলার বাদী

    কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সিনহা হত্যা মামলায় ৮৩ জন সাক্ষী রয়েছেন। গত ২৭ জুন এই মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য টানা তিন দিন ১৫ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন। কিন্তু চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে আদালতে শুধু জামিন শুনানি হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উচ্চ আদালতের নির্দেশ সাপেক্ষে মামলাটির কার্যক্রম শুরু হবে।

    ২৬ থেকে ২৮ জুলাই ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছিলেন আদালত। নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি

    সিনহা হত্যায় র‍্যাবের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বিজিবি তল্লাশিচৌকি অতিক্রম করে ঘটনার দিন রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিনহার গাড়ি শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পৌঁছালে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্যরা সংকেত দেন, গাড়ি থামে। পরিচয় পাওয়ার পর স্যালুট দিয়ে গাড়িটি চলে যাওয়ার সংকেত দেন এপিবিএনের সদস্যরা। মেজর সিনহা গাড়িটি এগোনোর চেষ্টা করতেই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী গাড়ির সামনে আসেন এবং সিনহার পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। সিনহা পরিচয় দিলে লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেন। তখন লিয়াকতের সঙ্গে এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতও রাস্তা ব্লক করার কাজে সহযোগিতা করেন।

    লিয়াকত আলী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর পিস্তল তাক করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গাড়িতে থাকা লোকদের দুই হাত ওপরে উঠিয়ে নামতে বলেন। প্রথমে গাড়ির দ্বিতীয় আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। চালকের আসনে বসা মেজর সিনহা গাড়ি থেকে দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কাম ডাউন, কাম ডাউন’ বলে লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এ সময় লিয়াকত আলী মেজর সিনহাকে প্রথমে দুটি গুলি করেন এবং কয়েক কদম এগিয়ে আরও দুটি গুলি করলে সিনহা রাস্তায় পড়ে যান বলে উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে।

    গুলি করার সময় লিয়াকত আলী মেজর সিনহা ও সিফাতকে হ্যান্ডকাফ পরানোর নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো এসআই নন্দদুলাল সিনহার হাতে হ্যান্ডকাফ পরান। হ্যান্ডকাফ না থাকায় সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর লিয়াকত মেজর সিনহাকে গুলি করার ঘটনা মুঠোফোনে ওসি প্রদীপকে এবং কিছুক্ষণ পর কক্সবাজার পুলিশ সুপারকে জানান। ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ সাদা মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। লিয়াকতের সঙ্গে একান্তে আড়ালে আলাপ সারেন প্রদীপ। তাঁরা সিনহাকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে ঘটনাস্থলে ফেলে রাখেন।

    হত্যা মামলার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওসি প্রদীপের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন ভিন্ন কথা। তাঁর দাবি, সিনহা হত্যার সঙ্গে ওসি প্রদীপ জড়িত নন। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের যে জিরো টলারেন্স নীতি, ওসি প্রদীপ সেই দায়িত্বই পালন করেছেন। তিনি আরও বলেন, অভিযোগপত্রে মেজর সিনহাকে গলায় বুট জুতা দিয়ে (ওসি প্রদীপ) চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তা পাওয়া যায়নি।

    বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, মামলার ১৫ আসামির মধ্যে ১২ জনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে দোষ স্বীকার করেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করে দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

    ঘটনার পরপর সিনহা হত্যার ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পুলিশের হঠকারী, প্রস্তুতিহীন ও অপেশাদারি আচরণ বলে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি বলেছে, যথাযথ তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে গুলিবর্ষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে অসংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। আত্মরক্ষার আইনি সুবিধার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এসব বন্ধে কমিটি ১৩ দফা সুপারিশও করেছে।

    সিনহা হত্যার সঙ্গে ওসি প্রদীপ জড়িত নন। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের যে জিরো টলারেন্স নীতি, ওসি প্রদীপ সেই দায়িত্বই পালন করেছেন।

    রানা দাশগুপ্ত, ওসি প্রদীপের আইনজীবী

    সিনহার পরিবারের দাবি, ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের পরিকল্পনায় সিনহা খুন হন। সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, মামলার ৮৩ জন সাক্ষী একেক জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন। সাক্ষীদের যথাসময়ে আদালতে হাজির করাও কঠিন হতে পারে। করোনা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই সামনে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হলে কম সময়ের ব্যবধানে মামলার তারিখ রেখে টানা তিন থেকে চার দিন সাক্ষ্য গ্রহণ যাতে করা হয়। এতে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।

    শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস আরও বলেন, ‘সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে অপরাধীদের কী শাস্তি হয়, তা দেখার জন্য। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন হয়।’

    Source: Prothomalo