ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছে ট্রলার, দাম বেশ চড়া
গভীর সাগর থেকে ইলিশ ধরে ট্রলারগুলো ঘাটে ফিরতে শুরু করেছে। আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে একে একে শতাধিক ট্রলার কক্সবাজারের মহেশখালী চ্যানেল দিয়ে ঢুকেছে শহরের বাঁকখালী নদীতে। নদীর নুনিয়াছটা এলাকার ফিশারিঘাটে ভিড়ছে সব কটি ট্রলার। ট্রলারভর্তি ইলিশ, লাক্ষ্যা, কোরাল, গুইজ্যা, চাপা, মাইট্যাসহ নানা সামুদ্রিক মাছ। তবে মানুষের দৃষ্টি ইলিশের দিকে। ট্রলারের ইলিশগুলো প্রথমে নৌকায় বোঝাই করা হয়। তারপর সেই ইলিশ আনা হয় ফিশারিঘাট পাইকারি মাছ বিক্রির বাজার ‘মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে’।
এখান থেকে ব্যবসায়ীরা ইলিশ কিনে ট্রাক বোঝাই করে সরবরাহ করছেন চট্টগ্রাম, ঢাকা, বগুড়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফিশারিঘাটের এই বাজার ইলিশে সয়লাব। ইলিশকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে ফিশারিঘাটের।
কয়েকজন জেলে বললেন, টানা ৮৩ দিন ইলিশ আহরণ থেকে বিরত ছিলেন জেলার ৬ হাজার ট্রলারের ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি জেলে। তখন পরিবারে লেগে ছিল অভাব-অনটন। এখন আহরিত বিপুল ইলিশ চড়া দামে বিক্রি করতে পেরে মহাখুশি জেলেরা। জেলেরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন, এই আশায় জেলেপল্লিগুলোতে এখন খুশির বন্যা।
আজ সকাল ৯টার দিকে শহরের বাঁকখালী নদীর ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ নিয়ে ঘাটে ফিরেছে শতাধিক ট্রলার। আবার ইলিশ বিক্রি করে বহু ট্রলার রওনা দিয়েছে সাগরের পথে।
গত ২৩ জুলাই শেষ হয়েছিল ৬৫ দিনের টানা মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞা। অতিমারির এই সময়ে নিষেধাজ্ঞার ওই ৬৫ দিন জেলেদের কেটেছে খেয়ে না খেয়ে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আগেই শুরু হলো সাগরে লঘুচাপ, ভারী বর্ষণ। এ কারণে উত্তাল সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া হয়নি টানা আরও ১০-১২ দিন। ৩ আগস্ট সাগর শান্ত হলে জেলার টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া উপজেলার ছোট-বড় ছয় হাজার ট্রলার ইলিশ ধরতে সাগরে নামে। এখন সেই ট্রলারগুলো বড় বড় ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরতে শুরু করেছে।
সকালে ফিশারিঘাটের পাইকারি বাজারে বিক্রির জন্য তিন হাজার ইলিশ নিয়ে আসেন এফবি আল্লাহ মালিক ট্রলারের জেলেরা। ইলিশগুলোর ওজন ৮০০ থেকে ১ হাজার গ্রাম। ইলিশ বিক্রি করে জেলেরা পেয়েছেন ২৭ লাখ টাকা।
ট্রলারের মালিক ও শহরের ফিশারিঘাটের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টানা আড়াই মাস ট্রলারটি ঘাটে পড়ে ছিল। ৪ আগস্ট ট্রলার নিয়ে ২১ জেলে ইলিশ ধরতে যান সেন্ট মার্টিন উপকূলের দক্ষিণ-পশ্চিম সাগরে। তিন দিনে ট্রলারের জালে আটকা পড়ে তিন হাজারের বেশি ইলিশসহ নানা সামুদ্রিক মাছ। ইলিশ বিক্রির টাকায় আগের বকেয়া, জেলেদের মজুরি পরিশোধ করা হবে। কাল সকালে জেলেরা আবার ট্রলার নিয়ে সাগরে নামবেন ইলিশ ধরতে। আগামী কয়েক মাস সাগরে ইলিশ আহরণ চলবে।
শহরের নুনিয়াছটার শমশের আলীর এফবি নাহিদা ধরেছে ১ হাজার ইলিশ, বিক্রি করে পাওয়া গেছে ১০ লাখ টাকা। নতুন বাহারছড়ার শহীদুল হক সোহেলের এফবি উশান ট্রলারে ধরা পড়েছে ২ হাজার ৮০০ ইলিশ, বিক্রি করে পেয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। পেশকারপাড়ার ওসমান গণীর এফবি নিশান ট্রলারে ধরা পড়েছে ২ হাজার ৯০০ ইলিশ, বিক্রি করে পাওয়া গেছে ৩০ লাখ টাকা।
কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, দুপুর পর্যন্ত অন্তত ১০০টি ট্রলার ঘাটে ভিড়েছে। একেকটি ট্রলারে ইলিশ ধরা পড়েছে ৫০০ থেকে ৩ হাজার। পাশাপাশি অন্যান্য মাছও ধরা পড়েছে। এখন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ ইলিশ চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
ফিশারিঘাটের মৎস্য অবতরণকেন্দ্র থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় ইলিশ সরবরাহ করেন কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য সমবায় সমিতির সদস্যরা। সমিতির সদস্যসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই ফিশারিঘাট থেকে ইলিশবোঝাই পাঁচটি ট্রাক ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। প্রতিটি ট্রাকে ইলিশ বোঝাই হয়েছে ১২ হাজার করে। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি ট্রাকে গেছে ৬০ হাজার ইলিশ। কাল আরও বেশি ইলিশ সরবরাহ করা হবে। তিনি বলেন, জেলেদের জালে এখন বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। এ কারণে দামও কিছুটা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ইলিশে বাজার সয়লাব হলে দামও কিছুটা কমে যেতে পারে। ইলিশের দাম ওঠা-নামা করে ঢাকার বাজার পরিস্থিতির ওপর।
আজ ফিশারিঘাটে পাইকারিতে ৮০০ থেকে ১ হাজার গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকায়, ১ হাজার গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়, ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায় এবং ৫০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। শহরের বাহারছড়া, কানাইয়ারবাজার, কালুরদোকান, বড়বাজারে খুচরায় এই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দামে।
ফিশারিঘাট ছাড়াও টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, চকরিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, কুতুবদিয়া এলাকার ট্রলারেও ধরা পড়ছে বিপুল ইলিশ। দুপুর পর্যন্ত এসব এলাকা থেকেও ৭০ হাজারের বেশি ইলিশ বোঝাই করে ৭-৮টি ট্রাক ঢাকা ও চট্টগ্রামের পথে রওনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ ছিল। এ কারণে ইলিশের প্রজনন ও আকৃতি বেড়েছে অনেক গুণ। এখন জেলেরা বড় বড় ইলিশ ধরে ঘাটে ফিরছেন। ইলিশ বিক্রির টাকায় নিজেরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, দূর হচ্ছে জেলেপল্লির অভাব-অনটন। এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, গত বছর জেলায় আহরণ হয়েছিল ১৫ হাজার ২৫৬ মেট্রিক টন ইলিশ। এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার মেট্রিক টন। এখন যে হারে ইলিশ ধরা পড়ছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আশা করা যায়।
Source: Prothomalo