স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ শ্রমিক তসলিমার (১৬) মা ফিরোজা বেগম পুলিশের কাছে আকুতি করেছেন, ‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুইজ্জা দেন, স্যার’। মা-মেয়ে দুজনেই ওই কারখানায় কাজ করতেন। একজন নেই, আর একজন আছেন ও থাকবেন ‘বুকভরা যন্ত্রণা’ নিয়ে।

সোনারানী বর্মণ এখন শুধু তাঁর মেয়ের মৃতদেহ চাইছেন আর কপাল চাপড়াচ্ছেন, কেন কারখানায় দিলেন। তাঁর ১৪ বছরের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত, অভাবের তাড়নায় কাজে দিয়েছিলেন। মাত্র ১২ দিন আগে মেয়েটি কাজে যোগ দেয়। জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারখানায় অন্তত ১৬টি শিশু নিহত হয়েছে।

দায়ী কে? মালিক পক্ষ? শুধুই মালিক পক্ষ, সরকারি সংস্থার কি দায়-দায়িত্ব নেই? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কী বলে? ট্রাফিক পুলিশ জোর করে কয়েকজনকে ব্যস্ততম লামা-চকরিয়া মহাসড়কে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখেন, বালুবাহী ট্রাক এসে দুই ননদ-ভাবিসহ অন্তত তিনজনকে পিষে দিয়ে যায়, আরও চারজন আহত। জানতে ইচ্ছা করে, ট্রাফিক পুলিশের কী অবস্থা? অনেক দিন আগে নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। এখনো তা-ই চাই।

এসব সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা। ৯ জুলাই রাতে নিউইয়র্কের ১০১০ নিউজ-এ শুনলাম, বাংলাদেশে সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগুন তখনো জ্বলছিল, অনেকে নিখোঁজ। পরদিন সকালে জানলাম, রূপগঞ্জে জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের কথা। অভিযোগ, কারখানা ভবনের চার তলায় ছাদে ওঠার সিঁড়ির মুখের দরজাটি তালা-বন্ধ থাকায় মানুষ ছাদে যেতে পারেনি। শোনা যায়, কারখানায় অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র ছিল না। মালিক পক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

বাংলাদেশ উন্নতি করছে, এ গর্ব এসব শ্রমিকের ঘামে তিলে তিলে গড়া। কিন্তু এঁদের মরতে হয় পায়ে বেড়ি নিয়ে, বড় করুণ মৃত্যু। শ্রমিকের জীবনের কোনো মূল্য নেই, চড়া দাম মালিকের জীবনের। করোনা মহামারি আমাদের কিছুই শিক্ষা দিতে পারেনি, আমরা মানুষ হতে পারিনি। নিউজটি বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় বড় মিডিয়ায় এসেছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদও আছে, করোনায় একদিনে সর্বাধিক মৃত্যু তো আছেই। যদিও ফুটবল খেলার জোয়ারে এসব খবর তেমন গুরুত্ব পায়নি।

একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, কে কার খবর রাখে। একটা ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন হই চই হয়, তারপর ‘ব্যাক টু দ্য স্কয়ার’। সব ঠান্ডা, আরেকটি দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা। আর কত মানুষ বেঘোরে মরলে বলা যাবে, ‘গরিবের জীবনেরও মূল্য আছে’? মানুষের জীবন নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হোক।

এদিকে একটি হাসপাতালের দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ করায় জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি গ্রেপ্তার হয়েছেন। জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে শিরোনাম করেছে—হাসপাতালে ‘দুর্নীতি’: খবর প্রকাশ করায় বাংলাদেশে সাংবাদিকের হাতে হাতকড়া। একটি ছবি দেখলাম, হাসপাতালে শয্যার সঙ্গে হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় তিনি শুয়ে আছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কী বিচিত্র এই বাংলাদেশ।

এরই মাঝে খবর এল, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি পোশাক কারখানায় ফাটল ধরেছে। আতঙ্কে কর্মরত শত শত শ্রমিক বাইরে বের হয়ে যায়। ছোটাছুটি, কান্নাকাটি চলতে থাকে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রকৌশলীরা এসে শ্রমিকদের শান্ত করেন। জানা যায়, কারখানার চার তলার ফ্লোরে দীর্ঘ ফাটল। শ্রমিকেরা জানান, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ছয়তলা ভবন নির্মাণ হয়েছে, আবার নতুন করে নির্মাণকাজ চলছে। কাজ চলাকালীন ভবনের নিচতলায় একটি দেয়াল ধসে পড়ে। ভাগ্য ভালো, হতাহতের খবর নেই।

Source: Prothomalo