করোনায় দুস্থদের পাশে তারা

রাজধানীর পূর্ব বাড্ডা পোস্ট অফিস রোড ধরে গেলে বাড্ডা মাছের আড়ত। সেখান থেকে সামান্য একটু দূরেই গলির মুখে রাস্তা থেকে নিচু একটি বাড়ি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে আসবাববিহীন কক্ষের ভেতরটা দেখা যায়। গত শনিবার বেলা একটায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি চলছে। দু–তিনজন শিশু রাস্তায় অপেক্ষা করছে।

বেলা দুইটার মধ্যে ৩ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ১৫ জন হয়ে যায়। পরে তারা কক্ষটিতে গিয়ে মেঝেতে বিছানো চাদরে বৃত্তাকার হয়ে খেতে বসে। মেন্যু—পোলাও, আলু-মুরগির ঝোল, শসার সালাদ ও এক টুকরা লেবু। কয়েক দিন ধরে নিম্নবিত্ত ওই এলাকার এই শিশুরা দুপুর বেলা একসঙ্গেই খাচ্ছে। তাদের প্রতিদিনের এক বেলা খাবারের এই খরচ আসে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন থেকে। করোনাকালে অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগেও দরিদ্র মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন।

অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই প্রয়োজনীয়তার বোধ নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানবতা দিবস। ২০০৩ সালের এই দিনে ইরাকের বাগদাদের ক্যানাল হোটেলে বোমা হামলায় ইরাকে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধিসহ ২২ জন ত্রাণকর্মী নিহত হন। ওই ঘটনার পাঁচ বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৯ আগস্টকে বিশ্ব মানবতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, সমাজের একটি অংশের মধ্যে মানবতা বোধ সব সময় ছিল, আজও আছে।

প্রতিদিন ২০০ শিশুকে খাওয়ানো হয়: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী গত বছর অকালে হারানো সন্তান অমর্ত্যের স্মরণে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন। তাঁর নিজের মাসিক বেতন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের দানে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে করোনাকালে টিউবওয়েল স্থাপন, শিক্ষা উপকরণ, খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ করা হচ্ছে। দেড় মাস আগে বরিশাল ও বাগেরহাটে শুরু হয় দরিদ্র শিশুদের দুপুরে রান্না করে খাওয়ানো। এখন ঢাকার বাড্ডায় দুটি এবং সিলেট, ভোলার চরফ্যাশনসহ ছয়টি জায়গায় প্রায় ২০০ শিশুকে খাওয়ানো হয়। প্রতিদিন এক বেলা খাওয়াতে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা।

এই কর্মসূচিটি ঢাকা থেকে সমন্বয় করছেন এইচ এম রিয়াজ। তিনি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান রবির ‘গ্রাহক বিশ্বস্ততা কর্মসূচির’ কার্যকরী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে মানুষের পাশে যা আছে তা নিয়েই দাঁড়িয়েছে অমর্ত্য ফাউন্ডেশন।’

গরুর জন্য গয়না বিক্রি করতে চেয়েছিলেন রোমা: রাজধানীর হাজারীবাগে ‘অমৃতম’ থেকে প্রতিদিন দুপুরে খাবার পায় ৬৮ শিশু। এর প্রতিষ্ঠাতা আফ্রিকা রোমা তাঁর আয় ও বন্ধু-স্বজনদের কাছ থেকে আসা অর্থ দিয়ে এই খরচ চালান। ওই শিশুরা একদিন কথায় কথায় জানায়, তারা কখনো কোরবানির গরুর মাংস খায়নি। তিনি শিশুদের কথা দেন, গরু কিনে দেবেন। কিন্তু ওই সময় তাঁর হাতে টাকা ছিল না। এ কারণে গয়না বিক্রি করতে চেয়েছিলেন।

আফ্রিকা রোমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা আমার জন্য ওই গয়না রেখে গেছেন। আমার মা স্কুলশিক্ষক হালিদা চৌধুরী মারা গেছেন ২০১৯ সালে। তবে শেষ পর্যন্ত আমাকে গয়না বিক্রি করতে হয়নি। তাঁর মতোই অনেক মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন গরু কেনার উদ্যোগে। ঈদুল আজহার তিন দিন আগে ৭৭ হাজার টাকায় ওই শিশুদের জন্য গরু কেনা হয়। কোরবানির আগপর্যন্ত শিশুরাই গরুটির দেখভাল করে।’

অক্সিজেন সরবরাহ করে ‘সংযোগ’: গত ১ জুলাই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তহমিনা খানমের বাবা মোস্তফা খান (৭০)। ওই সময় মা আনজিরা বেগমও (৬৫) আক্রান্ত হন। সংযোগ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ফেসবুকে এ তথ্য জানতে পেরে মায়ের জন্য যোগাযোগ করেন তহমিনা। তিনি বলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের বাসায় এক ব্যক্তি বিনা মূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেন। এমনকি অটোরিকশার ভাড়াও নেননি।

সংযোগের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাসিমুল আহসান জানান, এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি রোগীকে অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২০০ জন পেয়েছেন বিনা মূল্যের সার্ভিস।