তালেবানের পুনরুত্থান ও দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির নতুন হিসাব–নিকাশ

আফগানিস্তানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান প্রশাসন দেশটির নেতা ঘোষণা করেনি। প্রথম দিকে শোনা যাচ্ছিল ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের একসময়কার সহকর্মী আলী আহমেদ জালালি দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান হতে পারেন। পরে শোনা গেল তালেবানপ্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার সরাসরিই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না।

এদিকে খবর বেরিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটো দেশ—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দুই ঝানু কূটনীতিক মার্কিন প্রেসিডেন্টের আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ দূত জালমাই খালিলজাদ এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিশেষ প্রতিনিধি জমির কাবুলভ পর্দার আড়ালে থেকে দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাদাভাবে তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন, যদিও এই আলোচনার বিষয়ে বিশদ কিছু জানার সুযোগ আপাতত নেই।ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাবুলে তাদের দূতাবাস সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়ে তাদের লোকদের নিজ দেশে সরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও তুরস্ক তাদের দূতাবাসগুলো ঠিকই চালু রেখেছে। এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে যে তালেবান সরকার গঠিত হলে এই দেশগুলো সে সরকারকে স্বীকৃতি দিতে আপত্তি করবে না। তাই সংগত কারণেই অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগছে, গত ২০ বছরে কী এমন ঘটল যে কট্টর মৌলবাদী তালেবান আর নাস্তিক কমিউনিস্ট সব এক কাতারে এসে মিলে গেছে? এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে চীনের প্রশ্নটা বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ, ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন ক্ষমতা দখল করে, চীনকে তারা গণ্য করত অন্যতম প্রধান শত্রু হিসেবে। চীনও তালেবানকে তার শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করেছে। এ ছাড়া এই মুহূর্তে চীনে রয়েছে উইঘুরের মতো একটা ইস্যু, যার জন্য তাকে প্রায়ই আন্তর্জাতিক সমালোচনা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাই চীন-তালেবান বর্তমান সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই হাজারো প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে।

তালেবান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য তালেবানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সাক্ষাতের দুই সপ্তাহের মধ্যেই তালেবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।

অবশ্য চীন নিজেই প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে এসেছে। তালেবানের কাবুল দখলের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে গত ২৮ জুলাই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই চীনের উত্তরাঞ্চলীয় তিয়ানজিন বন্দরে নয় সদস্যের এক তালেবান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আজকের বহুল আলোচিত তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য, ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং মার্কিন প্রশাসনের চাপে তাঁকে সে সময়ে মুক্তি দেওয়া হয়।

তালেবান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য তালেবানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সাক্ষাতের দুই সপ্তাহের মধ্যেই তালেবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এরপর পরই চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং এক বিবৃতিতে বলেন, ‘চীন আশা করে, তালেবান নেতৃত্ব আফগানিস্তানের সব রাজনৈতিক দল ও নৃগোষ্ঠীকে একত্র করে একটা রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করিয়ে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভিত্তি রচনা করতে পারবে।’

তালেবানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের এই ‘অতি দ্রুততায়’ নতুন করে সামনে এসেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ধারণার কথা, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দলিলে ২০১৩ সালে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অবশ্য ২০১০ সালে মার্কিন প্রশাসনও এ ধরনের একটি প্রয়াস চালিয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি। মার্কিন সেনাপ্রধান জেনারেল ডেভিড প্রট্রাউস আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ২০১০ সালে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেন, যা ২০১১ সালে তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ভারতের চেন্নাইতে গিয়ে উপস্থাপন করেন। কিন্তু ভ্রূণেই মারা যায় মার্কিন প্রয়াস। দুই বছরের মধ্যে চীন হাজির হয় তার নতুন প্রস্তাবনা বিআরআই নিয়ে। ইতিমধ্যেই খবর বেরিয়েছে, তালেবান ঘোষণা করেছে, তারা আফগানিস্তান অংশে বিআরআই বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে।

প্রশ্ন হলো চীনকেই-বা এর জন্য তালেবানের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার পড়ল কেন? কিংবা তালেবানই-বা কেন তাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী এবং ওস্তাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হলো। ভবিষ্যৎই এর জবার দেবে। তবে দু-একটা বিষয় এখনই রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।

প্রথমত, চীন চায় না তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সীমান্তের কাছাকাছি থাকুক। এ ছাড়া চীন মনে করে, উইঘুর ইস্যুতে মার্কিনের মদদ রয়েছে এবং তারাই একে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। দ্বিতীয়ত, গত ২০ বছরের কারজাই এবং গনি শাসন এ কথা প্রমাণ করতে পারেনি যে তাদের বিশ্বাস করা যায়। এই ২০ বছর দেশটি সুশাসনের অভাবে আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে শহরকেন্দ্রিক কিছু উন্নয়ন হলেও গ্রামগঞ্জের মানুষ তার কোনো ছোঁয়া পায়নি।

সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা তালেবান পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করেছে, তা হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ২০ বছর বিচারব্যবস্থার পুনর্গঠনের কোনো প্রয়াসই নেওয়া হয়নি। ফলে, গ্রামের মানুষ তালেবান বিচারব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে, পশ্চিমা উপদেষ্টারা পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন আফগানিস্তানে। কারজাই বা গনি তাঁদের প্রেসক্রিপশন গিলেছেন, ওষুধের দিকে তাকিয়ে দেখেননি। এই সুযোগে দুর্নীতি সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে। মনে পড়ে ২০০৯-১০ সালের দিকে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে মনে করা হতো আফগান পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতে প্রায় অর্ধেক ভুতুড়ে সেনা (ঘোস্ট ফোর্স) রয়েছে, যাদের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব ছিল না। অথচ তাদের নামে বেতন-ভাতা তোলা হতো।

সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা তালেবান পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করেছে, তা হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ২০ বছর বিচারব্যবস্থার পুনর্গঠনের কোনো প্রয়াসই নেওয়া হয়নি। ফলে, গ্রামের মানুষ তালেবান বিচারব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এভাবে কারজাই ও গনি—উভয়ই জনবিচ্ছিন্ন পশ্চিমা পুতুল বলেই বিবেচিত হওয়া শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে। এ সুযোগই গ্রহণ করে ধর্মভিত্তিক সংগঠন তালেবান।

এ ক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য। কারজাই কিংবা গনি—দুজনই উচ্চ শিক্ষিত হলেও তাঁদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। এ কারণে তাঁরা দেশটির রাজনৈতিক উন্নয়নে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি। বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দলও নেই, যার দেশজুড়ে রয়েছে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হিজবে ইসলামি এবং জামায়েত ইসলামির অল্পবিস্তর গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও তা বিশেষ বিশেষ নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এদিক থেকে তালেবানই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি, যার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবসা (ডিল) করা যায়। এই বাস্তবতায় চীন ও তালেবান একে অপরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে অনেকেই কাবুলের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে তালেবানের বিজয় মনে করে নীরব উল্লাসে মেতে উঠেছেন। অনেকেই আবার উদ্বিগ্নও হচ্ছেন। আমি মনে করি, দুই শিবিরের প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক। একজন বাম ঘরানার মানুষ যদি ভেনেজুয়েলা কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশে লাল পতাকার বিজয়ে উল্লসিত হতে পারেন, তাহলে ধর্মীয় মৌলবাদে বিশ্বাসী একজনও তালেবানের বিজয়ে স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত হবেন। এতে হয়তো সমস্যা নেই, কিন্তু সমস্যাটা হবে তখনই, যখন পরদেশে কোনো শক্তির বিজয় নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর লালিত মূল্যবোধে আঘাত হানার কারণ হয়ে দেখা দেয়। এ কারণেই বাংলাদেশের অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগছে, আফগানিস্তান পরিস্থিতি কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে বা ফেলতে পারে? যদি ফেলে, এর রূপটা কী হতে পারে?

আমার ধারণা—অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। তালেবান সমর্থক গোষ্ঠী যে এতে একটা বড় ধরনের ‘বুস্ট’ পাবে। অন্যদিকে, সরকারকে মৌলবাদীদের বিষয়ে আরও কুশলী হতে হবে। দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর যদি বিস্তৃত না হয়, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন করতে গিয়ে সরকার যদি মৌলবাদীদের ছাড় দেওয়ার কৌশল নেওয়া অব্যাহত রাখে তবে আমাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। আর আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হবে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার যে প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তাতে এ অঞ্চলে তার বিশেষ মিত্র ভারত বেশ বেকায়দায় পড়েছে। বাংলাদেশ এখন কোন দিকে যাবে? অতীতের ‘সুখ-দুঃখের সঙ্গী’ ভারত, নাকি নতুন উন্নয়ন সহযোগী চীন?

মোশতাক আহমেদ আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সাবেক পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার

Source: Prothomalo