ঢাবিতে সাড়ে ১৭ লাখ টাকার কাজে অনিয়মের অভিযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হল ও আবাসিক ভবনে লোড ব্রেক সুইচ (এলবিএস) স্থাপনের প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকার কাজে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

যেসব ভবনে এলবিএস স্থাপন করার কথা, তার বেশির ভাগ জায়গায় এখনো তা পৌঁছায়নি। কোথাও দু-একটি যন্ত্রাংশ পাল্টে দিয়ে পুরোনো এলবিএসকে রং করে দেওয়া হয়েছে। কাজের বিষয়ে গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর মতামত নেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। কাজ শেষ না হতেই ঠিকাদারকে তড়িঘড়ি করে চূড়ান্ত বিল পরিশোধের চেষ্টা চলছে।

এলবিএস মূলত একটি সুইচিং ডিভাইস। সাধারণত বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি থেকে যে এইচটি (হাই টেনশন) বিদ্যুৎ আসে, সেটি চাইলে ট্রান্সফরমারে সরাসরি ইনপুট দেওয়া যায়। কিন্তু প্রতিকূল বা জরুরি মুহূর্তে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। তাই সেটিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রান্সফরমারের ক্ষমতা অনুযায়ী লোড ব্রেক সুইচ বা ভ্যাকুয়াম সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার হয়। ৫০০ কিলো ভোল্ট অ্যাম্পিয়ারের চেয়ে কম ক্ষমতার ট্রান্সফরমারে লোড ব্রেক সুইচ ব্যবহার করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হল ও আবাসিক ভবনে নষ্ট এলবিএস পরিবর্তন শীর্ষক কাজের আওতায় শামসুন নাহার হল, অমর একুশে হল, জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতি ভবন, সুইমিং পুল ও এ এন এম মুনীরুজ্জামান ভবনে নষ্ট হয়ে যাওয়া এলবিএস পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নতুন এলবিএস স্থাপনের কথা।

নথিপত্র অনুযায়ী, মার্সনস ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি পেয়েছে। ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।

কাজ শেষ না হওয়া সত্ত্বেও গত জুনে এ-সংক্রান্ত বিলটি ‘পাস করা যায়’ বলে মতামত দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. লুৎফর রহমান।

নথিপত্র অনুযায়ী, প্রতিটি এলবিএসের দাম ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৯ টাকা। সে হিসেবে পাঁচটি এলবিএস পরিবর্তনের জন্য ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৪৯৫ টাকার বিল চাওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিং পুল ও শামসুন নাহার হলে একটি করে নতুন এলবিএস লাগানো হয়েছে। অমর একুশে হলে শুধু দুটি যন্ত্রাংশ (সিটি ও পিটি নামক) পাল্টে দিয়ে পুরোনো এলবিএসকে রং করা হয়েছে। জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতি ভবনে এখন পর্যন্ত কোনো নতুন এলবিএস পৌঁছায়নি। এ এন এম মুনীরুজ্জামান ভবনেও নতুন এলবিএস যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, কাজটির বিলের ওপর স্টোর অফিসার মালামাল বুঝে পেয়েছেন বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো কোনো ভবনে এলবিএস এখনো পৌঁছায়নি। কোথাও শুধু দু-একটি যন্ত্রাংশ পাল্টে দিয়ে পুরোনো এলবিএসকে রং করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নতুন এলবিএস স্থাপন করা হয়েছে বলে বিল চাওয়া হয়েছে।

ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র পরিবর্তন না করা বা শুধু যন্ত্রাংশ পাল্টে রং করার ফলে নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। ফলে সম্ভাব্য এই ঝুঁকির দায় কে নেবে, তা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, কোনো কাজ শেষ হওয়ার পর ব্যবহারকারী বা গ্রাহকের মতামত বা প্রত্যয়ন নিয়ে বিল উপস্থাপন করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শুধু তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর মতামত আছে। ব্যবহারকারী বা গ্রাহকের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।

কাজ শেষ না হতেই ঠিকাদারকে তড়িঘড়ি করে চূড়ান্ত বিল পরিশোধের জন্য নথি উপস্থাপনের পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. লুৎফর রহমান ‘সিন্ডিকেট’ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সাবেক-বর্তমান নেতা ও পছন্দের ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকৌশলের কাজ দিয়ে থাকেন। কাজের মানের সুষ্ঠু তদারকির দায়িত্বে থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি বিষয়টি উপেক্ষা করেন। লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে।

জানতে চাইলে মো. লুৎফর রহমান প্রথম আলোর কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘পাঁচটি এলবিএসই আমাদের কাছে আছে। যখন যেখানে প্রয়োজন হবে, লাগাব। পাঁচটির মধ্যে কয়টি লাগানো হয়েছে, তা দেখে বলতে হবে। তবে ফিজিক্যালি পাঁচটিই আছে। এক-দেড় বছর আগে এর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর অমর একুশে হলের এলবিএসটি মেরামত করে চালু করে দেওয়া হয়েছে। নতুন পাঁচটি পাঁচ জায়গায় আছে।’

পাঁচটি এলবিএস দেখানো সম্ভব কি না, জানতে চাইলে লুৎফর রহমান বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।’

গ্রাহকদের মতামত না নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে লুৎফর রহমান বলেন, ‘তাঁদের বলার পর তাঁরা বলেছেন যে এটা আমাদের কোনো পার্ট নয়। এর চাহিদাও তাঁরা দেননি।’

তবে যেসব ভবনে এলবিএস স্থাপনের কথা, সেসব ভবনের কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে লুৎফর রহমানের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি।

জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবনে কোনো এলবিএস আসেনি। কীভাবে এর বিল হলো, কী হলো, এ বিষয়ে আমি অবহিত নই।’

অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ ইশতিয়াক এম সৈয়দ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। এলবিএস স্থাপনের বিষয়ে আমাদের কোনো মতামতও নেওয়া হয়নি।’

এ এন এম মুনীরুজ্জামান ভবন কমিটির একজন নেতা জানান, তাঁদের ভবনেও নতুন এলবিএস পৌঁছায়নি।

কাজটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্সনস ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের পরিচালক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আতিকুর রহমান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাজ ছিল এলবিএস সরবরাহ করা। সেটি তাঁরা করেছেন। এলবিএস স্থাপনের কাজটি প্রকৌশল দপ্তরের।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত যারা যন্ত্র সরবরাহ করে, তারাই তা ইনস্টল করে দেয়। এই কাজে প্রকৌশল দপ্তর সহযোগিতা করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালকের দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘প্রশ্ন ওঠা’ বিল এখন প্রক্রিয়াধীন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার কানেও এসেছে। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, নিরাপত্তা—সবকিছু জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অনিয়ম বরদাশত করা হবে না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।’