কাবুল দখলের প্রস্তুতি তালেবানের
পশ্চিমানির্ভর আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের একেবারে দ্বারপ্রান্তে তালেবান। একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ধারাবাহিক সাফল্যের অংশ হিসেবে সশস্ত্র সংগঠনটির যোদ্ধারা গতকাল শনিবার দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় লোগার প্রদেশ দখল করে নিয়েছেন।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে, লোগার প্রদেশের আইনপ্রণেতা হোদা আহমাদি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। লোগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তালেবান সদস্যরা প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের আটক করেছেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, এই যোদ্ধারা চর আসিয়াব জেলায় পৌঁছেছেন। তাঁরা কাবুল থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার (৭ মাইল) দূরে অবস্থান করছেন।
ঝোড়োগতিতে দেশের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে তালেবানের এভাবে পৌঁছে যাওয়াটা অনেকের কাছেই এখন বিস্ময়ের নয়। কেননা গত মে মাস থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত আফগান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ জোরদার করেছে। ধাপে ধাপে দেশটির উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে তারা।
এসব অঞ্চল তালেবানবিরোধী এবং সরকার ও তার প্রতি অনুগত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। শুধু গত কয়েক দিনেই দেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাত এবং কান্দাহারসহ ৩৪ প্রদেশের ১৮টি দখল করে নিয়েছে তালেবান।
সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কাবুলে সাঁড়াশি আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি হিসেবে গতকাল তালেবান উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর মাজার–ই–শরিফ লক্ষ্য করে বহুমুখী হামলা চালায়। পাশাপাশি দেশজুড়ে আরও প্রদেশ ও শহর দখলে অভিযান অব্যাহত রাখে তারা।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক সেনাদের আফগানিস্তান ছাড়ার তোড়জোড় এবং অন্যদিকে সরকারি সেনাদের ওপর তালেবানের চড়াও হওয়া—এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো মুহূর্তে কাবুলের পতন ঘটতে পারে বা দেশটি আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধে পতিত হতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের দুই–তৃতীয়াংশ এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। দুই পক্ষের লড়াইয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে ও তালেবানের প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় হাজার হাজার মানুষ কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে পালাচ্ছে। তালেবান যোদ্ধারা রাজধানীর কাছাকাছি চলে আসায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো তাদের দূতাবাসকর্মীদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে।
গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস গত শুক্রবার বলেছেন, আফগানিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত ও গৃহযুদ্ধে পতিত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। দেশটিতে আল–কায়েদার মতো গোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে পারে এবং তারা আবার পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
সেনাদের অস্ত্র তালেবানের কবজায়
এএফপি বলেছে, তালেবানকে পরাজিত করতে যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছরে আফগান সেনাদের শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। দিয়েছে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ। কিন্তু এর কিছুই এখন কাজে লাগছে না।
সেনাদের অসহায় আত্মসমর্পণে এসব অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ তালেবান যোদ্ধাদের কবজায় চলে যাচ্ছে। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে তালেবানের সাফল্য বেগবান করছে।
এদিকে তালেবানের সঙ্গে লড়াই করার সামান্য আগ্রহও আফগান প্রতিরক্ষা বাহিনী দেখাতে পারছে না। যেটা পারছে তা হলো, তালেবানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে তালেবান যোদ্ধাদের অস্ত্রভর্তি বাক্স জব্দ করতে দেখা যাচ্ছে; যার বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর সরবরাহ করা।
জাতির উদ্দেশে গনির ভাষণ
রয়টার্স জানায়, তালেবান যোদ্ধারা কাবুলের আরও কাছে চলে আসার প্রেক্ষাপটে গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। টেলিভিশনের সম্প্রচারিত এই সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন, দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় নেতারা এবং আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে জরুরি আলাপ–আলোচনা করেছেন তিনি।
আশরাফ গনি বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, সহিংসতা ও সাধারণ লোকজনের বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপরে মনোযোগ দিচ্ছেন। যুদ্ধবিরতি বা রাজনৈতিক সমঝোতার শর্ত হিসেবে তাঁর পদত্যাগের জন্য তালেবানের দেওয়া শর্তের বিষয়ে কিছু উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তাব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীকে পুনরায় সংহত করা আমাদের অগ্রাধিকারের বিষয়। এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বান
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তালেবানকে অবিলম্বে আক্রমণ বন্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধের এখনই সময়। সমঝোতার লক্ষ্যে এখনই গুরুত্বের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করতে হবে।’ তিনি বলেন, দখলের পর শহরগুলোতে নারী স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন করছে তালেবান।
২০ হাজার শরণার্থী নেবে কানাডা
এএফপি জানায়, কানাডা সরকার শুক্রবার বলেছে, আফগানিস্তানে চলমান লড়াইয়ে গৃহহীন হওয়া বাসিন্দাদের মধ্যে ২০ হাজার জনকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করবে তারা। এর মধ্যে তালেবানের হুমকি পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা, নারী রাজনীতিবিদ ও অন্যরাও থাকবেন।
Source: Prothomalo