যেমন চলছে হকারদের জীবন
সাজন আহম্মেদ পাপন
হকারদের সম্পর্কে কেউ তেমন জানতে চান না। জানতে চান না তাদের সুখ-দুঃখের কথা। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তাদেরও আছে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন, আছে জীবনের সুখ আর দুঃখের অনেক গল্প। কিন্তু তাদের জীবনপাতার গল্পগুলো লিখা হয় জীবন সংগ্রামের কাহিনী দিয়ে। নিরবে নিভৃতে তারা চালিয়ে যায় জীবন সংগ্রাম। কিশোরগঞ্জ শহর ঘুরে কয়েকজন হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো তাদের জীবন সংগ্রামের কথা। শহরের গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজের পাশে বসে মসলা ও শরবত তৈরির উপকরণাদি বিক্রয় করেন প্রায় ৪৫ বছর বয়সী সোহেল। বিভিন্ন হাট-বাজারে ২৩ বছর ধরে তিনি এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সোহেলের বাড়ি শহরের বত্রিশ মনিপুর এলাকায়। তার ২ মেয়ে, ১ ছেলে। বড় মেয়ে ৫ম শ্রেণীতে, ছেলে ৩য় শ্রেণী ও ছোট মেয়ে ১ম শ্রেণিতে পড়ে। সোহেল বলেন, স্বপ্ন দেখি সন্তানেরা পড়াশোনা করে চাকরি করবে, এজন্যইতো এ শ্রম। এখানে বসে মসলা ও শরবতের উপকরণাদি বিক্রি করে ২৫০-৩০০ টাকা লাভ থাকে। এ দিয়ে কষ্ট করে চলি। বৃষ্টির দিন ব্যবসা করা যায় না। তাছাড়া মোবাইল কোর্ট আসলে ব্যবসা বন্ধ করে চলে যেতে হয়। ১৭ বয়সী হিমেল। ৩ বছর যাবত ভ্যানগাড়ি দিয়ে গেঞ্জি এবং শীতের কাপড় বিক্রয় করে আসছে গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজের পাশে। কথা বলে জানা যায়, তার বাড়ি শহরের তারাপাশা এলাকায়। বাবা মারা গিয়েছে বছর চারেক হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর অভাবের কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। মা-ছেলের সংসারে একমাত্র উপার্জনম ব্যক্তি সে। হাসতে ভালোবাসে হিমেল। এবারের শীতে ব্যবসা নাকি খুব মন্দা। তবুও হাসিমাখা মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার এই ছোট কাঁধে পরিবারের দায়িত্ব। হিমেলের সাথে কথা বলার সময় এগিয়ে এলো তার পাশে ব্যবসা নিয়ে বসা ৪৫ বছর বয়সী ওমর ফারুক। সম্পর্কে হিমেলের চাচা। ওমর ফারুকও তার মতো গেঞ্জি এবং শীতের কাপড় বিক্রেতা। ওমর ফারুক জানান, ১০ বছর বয়স হতেই পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে চলে আসে। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। তিনি বললেন, ‘আমাদের পরিবারে ৯ জন সদস্য। ৩ জন পড়াশোনা করছে। কর্মম ব্যক্তি একমাত্র আমি।’ লাভ কেমন হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৫ বছর যাবত ব্যবসা নাই বললেই চলে। ব্যবসা হইলে ৩০০-৩৫০ টাকা লাভ হয়।’ একটু সামনে এগুতেই মোঃ আরশাদ আলী নামের আরেক হকারের সাথে দেখা হলো। তিনিও ব্রিজের পাশে গেঞ্জি ও শীতের কাপড় বিক্রি করেন। বয়স ৪২ হলেও চেহারায় বয়সের ছাপ আরো বেশি। সাংবাদিক পরিচয় জেনে নিজ থেকেই কথা বলতে আসলেন তিনি। বললেন, ‘ আমার ৪ মেয়ে। এর মধ্যে ২ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক মেয়ে মাদরাসায় পড়ছে।’ তার স্বপ্ন দুই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেয়া। আল্লাহর কাছে তার চাওয়া বাকিটা জীবন যেন দুমুঠো ডাল ভাত খেয়ে জীবনটা কাটাতে পারে। ব্রিজের পাশেই ফুটপাতে বসে তালা ও ছাতা মেরামত করেন শাহীন। বয়স ৩৫ বছর। বাবার কাছ থেকে শিখা এই বিদ্যা। এ কাজ করে প্রতিদিন তার ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়েই চলে তার সংসার। কথা বলে জানা গেল ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে খুব একটা স্বপ্ন নেই তার। তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া একমাত্র মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়তে চাওয়াই তার ল্য। পুরানথানা মোড়ে গিয়ে চোখে পড়লো হাতে ঠেলা ভ্যানে করে ডিম বড়া বিক্রি করছে একজন তরুণ। বয়স ২০। নাম জিজ্ঞেস করলে মৃদু স্বরে বলে আলামিন। কথা শুরু হয় আলামিনের সাথে। আলামিন বলেন, তার বাড়ি নিকলী দামপাড়া। পরিবারে কর্মম সে-ই। আলামিন জানায়, আধাবেলা রিকসা চালায় সে এবং সন্ধ্যার পর ডিম বড়া বিক্রি করেন। ৩ বোন ২ ভাই আর বাবা-মা নিয়ে তাদের সংসার। ২ বোনের বিয়ে দেয়া হয়েছে। এক বোন মাদরাসায় পড়ে। আরেক ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। অভাবের সংসারে ভাইটার পড়ালেখা কতদূর এগিয়ে নেয়া যাবে এ নিয়ে চিন্তিত আলামিন। সেই কবেই স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে আলামিন। পরিবার পরিজন নিয়ে কোনরকম খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারলেই হলো। শুধু সোহেল, হিমেল, ওমর ফারুক, মোঃ আরশাদ আলী, শাহীন এবং আলামিন নয়। এরকম আরও অনেক লোক প্রতিনিয়ত আমাদের আশেপাশে রয়েছে। যারা ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাজপথ, ফুটপাত ও গলিপথে জীবন ও জীবিকার তাগিদে নেমে আসে। তারা বিক্রি করেন আমাদের দরকারি নানা উপকরণ। এসব বিক্রি করে আমাদের চাহিদা মিটাতে পারলেও নিজেদের জীবনের চাহিদা মিটাতে পারেন না তারা। হকার জীবনের নিচে চাপা পড়ে থাকে যেন তাদের কষ্ট