হেপাটাইটিস আতঙ্ক, কিশোরগঞ্জের হারুয়া, গাইটাল ও বত্রিশ এলাকায় আক্রান্ত বেশী
কিশোরগঞ্জে হঠাৎ করে হেপাটাইটিস রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলছে। বিশেজ্ঞ ডাক্তার গণ ধারনা করছেন কিশোরগঞ্জের সাপ্লাই পানির সাথে সোয়ারেজ লাইনের সংযুগ গঠতে পারে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জের বিশেষ করে হারুয়া, গাইটাল ও বত্রিশ এলাকায় হেপাটাইটিস এ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে । কোন কোন পরিবারে সকলের মাঝে এ রোগের দেখা মিলছে।
হেপাটাইটিস এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সাধারণত নিজে থেকেই ভালো হয়ে যান। তবে যাঁদের জন্ডিস বেশি, বিশেষ করে যাঁদের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ১০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি কিংবা জটিল সমস্যা আছে, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। কখনো কখনো এই রোগের কারণে লিভার ফেইলিউরের ঘটনা ঘটে।
হেপাটাইটিস এ একটা ভাইরাস। যা ছড়ায় দূষিত পানি আর খাবারের মাধ্যমে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় লিভার (যকৃৎ)।
লিভারে হেপাটাইটিস এ হলে সাধারণত জন্ডিস হয়, তবে শুরুতেই নয়। শুরুটা হয় সাধারণত জ্বর, বমি বা বমিভাব, ুধামান্দ্য, পেটের ডান পাশের ওপর দিকে একটু ব্যথা ইত্যাদি দিয়ে। ৩০-৩৫ শতাংশ হেপাটাইটিস এ রোগীর জন্ডিস হয়, বাকিরা টেরও পান না কবে, কোথায়, কীভাবে তাঁকে হেপাটাইটিস এ ভাইরাসে আক্রান্ত করল।
হেপাটাইটিস এ ভাইরাস মূলত শিশুদের লিভারকে সহজে আক্রান্ত করে। বড়দের খুব একটা হয় না, তবে আজকাল কিছু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জীবনে একবার হেপাটাইটিস এ ভাইরাস সংক্রমণ হয়ে গেলে সারা জীবনের জন্য তার ওই প্রতিরোধমতা তৈরি হয়ে যায়। সাধারণত ১৫ বছরের আগেই এ দেশের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের কার্যকর টিকা আছে। সাধারণত যেসব রোগীর লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিউর, ক্যানসারের মতো জটিল রোগ থাকে, তাঁদেরই আমরা হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের ভ্যাকসিনটা দিয়ে থাকি।
বছরের এই সময়ে এ দেশে বন্যা হয়, আবার গরমও পড়ে বেশ। মানুষের পানি ও খাবারের সংকট দেখা দেয়। ময়লা পানি, বাসি খাবার অনেকে খান। যে কারণে হেপাটাইটিস এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কাজেই এই মৌসুমে হেপাটাইটিস এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সারা বছর তো বটেই, এই সময়ে বিশেষ নজর দিতে হবে পানি ও খাবারে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকলেই হেপাটাইটিস এ থেকে রা পাওয়া যাবে।
কী খাবেন কী খাবেন না
জন্ডিস বলতে সাধারণত আমরা লিভারের একিউট প্রদাহ বা একিউট হেপাটাইটিসজনিত জন্ডিসকেই বুঝে থাকি। তবে আমাদের দেশে একিউট হেপাটাইটিসের বা তাৎণিক রোগের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ই, এ এবং বি ভাইরাস। এর মধ্যে পানি ও খাদ্যবাহিত আর তৃতীয়টি ছড়ায় মূলত রক্তের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস এ ভাইরাস প্রধানত শিশুদের জন্ডিসের কারণ, তবে যে কোনো বয়সের মানুষই হেপাটাইটিস ই ও বি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এ ছাড়া বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি মানুষ এই বি ও সি ভাইরাস বহন করে বেড়াচ্ছে। আর এদের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১৪ লাখ মানুষ মারা যায় রোগাক্রান্ত হয়ে।
আমাদের প্রথাগত বিশ্বাস হচ্ছে- জন্ডিস হলেই বেশি বেশি পানি খেতে হবে। খেতে হবে বেশি করে আখের রস, ডাবের পানি, গ্লুকোজের শরবত ইত্যাদি। আসলে ব্যাপারটি এ রকম নয়। জন্ডিস রোগীকে সাধারণ মানুষের মতোই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে হবে। জন্ডিসের রোগীরা অনেক সময়েই বমি বা বমি-বমি ভাব এবং খাবারে অরুচির কারণে যথেষ্ট পরিমাণে পানি এবং অন্যান্য খাবার খেতে পারেন না। সেেেত্র রোগীকে শিরায় স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
বেশি বেশি পানি বা তরল খেলে প্রস্রাবের রঙ অনেকটাই হালকা বা সাদা হয়ে আসে বলে জন্ডিসের রোগীরা প্রায়ই বেশি বেশি তরল খাবার খেয়ে থাকেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যে, এতে জন্ডিস কিন্তু এতটুকুও কমে না। বরং বিশ্রামই যেখানে জন্ডিস রোগীর আসল চিকিৎসা, সেখানে প্রস্রাব করার জন্য বারবার টয়লেটে যেতে হলে রোগীর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটে, যা রোগীর জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়। আখের রস আমাদের দেশে জন্ডিসের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধ। অথচ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাস্তার পাশের যে দূষিত পানিতে আখ ভিজিয়ে রাখা হয় সেই পানি থেকেই অনেক সময় আখের রসে এবং তারপর ওই রস থেকে হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে।
আমাদের আরেকটি প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে রান্না করা তরকারি খেতে দেওয়া যাবে না। কারণ এতে রোগীর জন্ডিস বাড়তে পারে। আসল কথা হলো, রক্তে বিলিরুবিন নামক একটি হলুদ পিগমেন্টের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই জন্ডিস দেখা দেয়। এর সঙ্গে খাবারের হলুদের কোনো ধরনের সম্পর্কই নেই। একইভাবে জন্ডিসের রোগীকে তেল-মসলা না দিয়ে শুধু সিদ্ধ খাবার খেতে দেওয়ারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
তবে মনে রাখতে হবে, বাইরের খাবার সব সময় পরিহার করা উচিত। বিশেষ করে খুব সাবধান থাকতে হবে পানির ব্যাপারে। কারণ হেপাটাইটিস এ বা ই-এর মতো পানিবাহিত ভাইরাসগুলো এর মাধ্যমেই ছড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের খুব সাবধান থাকা উচিত।
গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে যদি হেপাটাইটিস ই হয়, তবে তা থেকে মা ও গর্ভের শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা শতকরা ৫০। জন্ডিস রোগে আক্রান্ত মা নিশ্চিন্তে তার সন্তানকে দুধ পান করাতে পারেন, তবে মায়ের যদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত জন্ডিস হয়ে থাকে তবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন ইঞ্জেকশন দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ মায়ের দুধের মাধ্যমে না ছড়ালেও, মায়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে শিশুর হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং আমাদের দেশে অনেক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের রোগী এভাবেই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
আগামী সংখ্যায় থাকছে লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ ডাঃ আবিদুর রহমান ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আতাউর রহমানের পরামর্শ।