কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর) আসন আওয়ামী লীগে প্রতিদ্বন্দ্বী কম বিএনপিতে প্রার্থীর ছড়াছড়ি
বিশেষ প্রতিনিধি
কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন। আসন পুনর্বিন্যাসের আগে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল একটি আসন এবং এটি ছিল কিশোরগঞ্জ -৩ আসন হিসেবে পরিচিত। নবম জাতীয় সংসদের আগে হোসেনপুর উপজেলাকেও কিশোরগঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় এবং সীমানা পুনর্বিন্যাস করে এটিকে করা হয় কিশোরগঞ্জ-১ আসন। বর্তমানে জেলার সাতটি সংসদীয় এলাকা থেকে কমিয়ে আসন সংখ্যা ৬-এ নামিয়ে আনা হয়। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ২৫ হাজার ৪ জন।
জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে এই আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর থেকে নির্বাচিত হন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আর বর্তমানে এই আসনের এমপি হলেন তারই সুযোগ্য পুত্র বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
স্বাধীনতার পর দশটি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ বার, বিএনপি ৩ বার ও জাতীয় পার্টি ১ বার এই আসন থেকে বিজয়ী হয়। ’৭৩ সালে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ’৭৯ সালে বিএনপির ডা: ফজলুল করিম, ’৮৬ সালে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, ’৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আলমগীর হোসেন, ’৯১ সালে বিএনপির মাওলানা আতাউর রহমান খান, ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির মাসুদ হিলালী, একই বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এবং ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরপর নির্বাচিত হন।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এই আসনেও ছড়িয়ে পড়েছে নির্বাচনী উত্তাপ। কর্মীসমাবেশের নামে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। আওয়ামী লীগের সমাবেশ হচ্ছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আর বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা গণসংযোগ ও পোস্টার-ব্যানারের মধ্যেই আপাতত তাদের নির্বাচনী প্রচারণা সীমাবদ্ধ রাখছেন। হামলা-মামলায় জর্জরিত বিএনপির নেতা-কর্মীদের নতুন করে ঝামেলায় জড়ানোর ভয়ে রাজপথে তাদের তৎপরতা চোখেই পড়ে না। বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচি পালন করা হয় খুবই সন্তর্পণে এবং নির্দিষ্ট গ-ির ভেতর। পুলিশের ঘেরাওয়ের ভেতরেই তাদের মিছিল-সমাবেশ করতে হয়। এদিকে নির্বাচন অংশগ্রহণের ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনার অভাবে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তোড়জোড়ের সঙ্গে মাঠেও নামতে পারছেন না।
গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনকালে দেখা যায় যে, এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে সাধারণত: কোনো উদ্বেগ-উৎকন্ঠা থাকে না। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিকল্প কোনো প্রার্থীর নাম কারো মাথায়ই কখনো আসে না। নেতা-কর্মীরা ধরেই থাকেন যে, এই আসনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই হচ্ছে শেষ কথা। এবছরও এর ব্যতিক্রম হবে বলে তারা মনে করেন না। তবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে এবং বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকায় নেতা-কর্মীদের কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবুও তারা আশা করছেন যে, নির্বাচনের আগেই তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসবেন এবং এই আসনের হাল ধরবেন। এলাকায় রয়েছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটি কীন ইমেজ। তাছাড়া ‘কিশোরগঞ্জ লেকসিটি’ গড়ার রূপকার তিনি। জেলা শহরকে দৃষ্টিনন্দনযোগ্য করে গড়ে তোলার নেপথ্য কারিগর তিনি।
তবে এই আসনে গত আট মাসাধিককাল যাবত ‘নৌকার পক্ষে’ ভোট চেয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মী সমা্েবশ ও গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠক করে চলেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক রাসেল আহমেদ তুহিন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ইদানিং সক্রিয় হলেও তার সঙ্গে রয়েছে বিশাল কর্মী বাহিনী। প্রতিটি সমাবেশকে ঘিরেই ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করা হয় এবং প্রতিটি সভা-সমাবেশেই ব্যাপক লোক সমাগম হয়। গত ২৮ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ পুরাতন স্টেডিয়ামে আয়োজিত বিশাল জনসভায় রাসেল আহমেদ তুহিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এখন পর্যন্ত ছোট বড় সব মিলিয়ে ৯০টি কর্মী সমাবেশ ও সমাবেশ করেছে। এছাড়াও দুস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ, বীজ ধান বিতরণ, চাল বিতরণ, কাপড় বিতরণ ও কিশোরগঞ্জ সদর, হোসেনপুরের ৬১টি পূজা মন্ডপতে একবস্তা চাল, ডাল বিতরণ করেছে। একান্ত সাক্ষাৎকারে রাসেল আহমেদ তুহিন বলেন, আমি বিভিন্ন সমাবেশে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের প্রচারণা করি এবং ‘নৌকার পক্ষে’ ভোট চাই। নিজের প্রার্থিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণ যদি চায় এবং দল যদি তাকে মনোনয়ন দেয় তাহলে তিনি কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেকে জনসেবায় নিয়োজিত করতে আগ্রহী। বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মী সমাবেশে ইউনিয়ন সভাপতি ও সমাবেশ থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মাঝি হিসেবে রাসেল আহমেদ তুহিন কে একাত্বা ঘোষণা করে।
এদিকে ১৪-দলীয় জোটের শরিক দল গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিম-লীর সদস্য ও জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক এই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি ব্যাপক পোস্টারিং করেছেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে করছেন ব্যাপক গণ-সংযোগ। করছেন মিটিং-মিছিলও। তিনি বলেন, দলের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই প্রচারণা চালাচ্ছি। এবছর শরিক দল হিসেবে ৫টি সীট গণতন্ত্রী পার্টির জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে বলে দলীয় হাইকমান্ডের ধারণা। তিনি নরসুন্দা নদী সংস্কারে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে দাবি করে যথাযথভাবে নদী খনন, সড়ক সংস্কার এবং জেলা শহরে ইজিবাইক চলাচলে নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
এই আসন থেকে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হিলালী। দলের সাংগঠনিক তৎপরতা থেকে তিনি এখন অনেকটা দূরে। তবে তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে দলের জেলা কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দল মনোনয়ন দিলে তিনি এবারও নির্বাচন করতে আগ্রহী। গুরুদয়াল সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক দুই ভিপি হাজী ইসরাইল মিঞা ও খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেলও নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আর যাদের নাম আলোচনায় রয়েছে তারা হলেন- জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওয়ালিউল্লাহ রাব্বানী, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি রেজাউল করিম খান চুন্নু প্রমুখ।